শখের মৃৎশিল্প | পঞ্চম শ্রেণি বাংলা | Class 5 Bangla
পেজ ---৩৪
শখের মৃৎশিল্প
গ্রামের নাম আনন্দপুর। মামার বাড়ি। কথায় আছে, মামার বাড়ি রসের হাঁড়ি। আসলেই তাই। পড়া নেই, বাধা নেই, যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াও, যা খুশি খাও। এই তো মামার বাড়ি। গেল বছর পহেলা বৈশাখের ছুটিতে গিয়েছিলাম আনন্দপুর। সেখানে পহেলা বৈশাখে মেলা বসে। মামা বললেন, তোমাদের মেলা দেখতে নিয়ে যাব।
আমরা ছিলাম চারজন--- আমি, মামাতো বোন বৃষ্টি, সোহানা আর ছোট ভাই তাজিন। মেলা বসে সকালে। আমরা একটু দেরি করেই গেলাম। মামা বেশ মজার মানুষ। কাঁধে ঝোলানো একটা ব্যাগ। তাতে থাকে ছবি আঁকার জিনিস, থাকে একটা বাঁশি। পড়েন ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউটে। মেলার একটু কাছে পৌঁছতেই শুনতে পেলাম নাগরদোলার ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দ। দেখলাম বাঁশের তৈরি কুলো, ডালা ঝুড়ি,চালুন, মাছ ধরার চাঁই, খালুই। আর ও কত কী! বসেছে বাঙি, তরমুজ, মুড়ি-মুড়কি, জিলাপি আর বাতাসার দোকান সারি সারি। আরেকটু এগোতেই দেখতে পেলাম কত রঙের, কত বর্ণের বিচিত্র সব মাটির হাঁড়ি। ফুল,পাতা, মাছের ছবি আঁকা সেসবে। রয়েছে মাটির ঘোড়া, হাত, ষাঁড় আর নানা আকারের মাটির পুতুল। আমার চোখ পড়ল কাজ করা অপূর্ব সুন্দর মাটির হাঁড়ির দিকে। মামাকে জিজ্ঞেস করলাম- এটা কিসের হাঁড়ি?
পেজ---৩৫
মামা বললেন, এটা শখের হাঁড়ি। শখ করে পছন্দের জিনিস এই সুন্দর হাঁড়িতে রাখা হয়। তাই এর নাম শখের হাঁড়ি। তাছাড়া শখের যেকোনো জিনিসই এইতো সুন্দর।
আমরা দুটি শখের হাঁড়ি কিনলাম। অবাক হলাম, পুতুলের পাশেই ঘোলা চোখে চেয়ে আছে এক চকচকে রূপালি ইলিশ। পদ্মা তাজা ইলিশের মতোই। তেমনি সাদা আঁশ, লাল ঠোঁট। আমরা একটা মাটির ইলিশও কিনলাম। মামা বললেন, এই যে পুতুলগুলো দেখছ এগুলো টেপা পুতুল। নরম এঁটেল মাটি টিপে টিপে এসব পুতুল বানানো হয়। যেমন-- বউ জামাই, কৃষক, নথ পরা ছোট্ট মেয়ে -নানা রকমের মাটির টেপা পুতুল। মেলার এক প্রান্তে বড় জায়গা জুড়ে এসব মাটির পুতুলের দোকান। মামা বললেন, এগুলো হচ্ছে মাটির শিল্পকলা। মামা বুঝিয়ে বললেন -যখন কোনে কিছু সুন্দর করে আঁকি বা বানাই অথবা গাই, তখন তা হয় শিল্প। শিল্পের এ কাজকে বলে শিল্পকলা। আমাদের দেশের সবচেয়ে প্রাচীন শিল্প হচ্ছে মাটির শিল্প। এ দেশের কুমার সম্প্রদায় যুগ যুগ ধরে তৈরি করে আসছে মাটির জিনিস। যেমন- কলস, হাঁড়ি,সরা, বাসনকোসন, পেয়ালা, সুরাই, মটকা, জালা, পিঠে তৈরির নানা ছাঁচ। আরও কত কী!
মাটির তৈরি শিল্পকর্মকে আমরা বলি মাটির শিল্প বা মৃৎশিল্প। এ শিল্পের প্রধান উপকরণ হলো মাটি। তবে সব মাটি দিয়ে এ কাজ হয় না। দরকার পরিষ্কার এঁটেল মাটি। এ ধরনের মাটি বেশ আঠালো। দোআঁশ মাটি তেমন আঠালো নয়। আর বেলে মাটি তো ঝরঝরে- তাই এগুলো দিয়ে মাটির শিল্প হয় না। এঁটেল মাটি হলেই যে তা দিয়ে শিল্পের কাজ করা যাবে তাও নয়। এজন্য অনেক যত্ন আর শ্রম দরকার। দরকার হাতের নৈপুণ্য ও কারিগরি জ্ঞান। কুমারদের কাছে এসব খুব সহজ। কারণ তাঁরা বংশ পরম্পরায় এ কাজ করে আসছে।
পেজ---৩৬
আবার এ কাজের জন্য প্রয়োজন কিছু ছোটখাটো যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম। সবকিছুর আগে যেটা দরকার তা হলো একটা কাঠের চাকা। এই চাকায় নরম মাটির তাল লাগিয়ে নেন কুমাররা। তারপর চাকাটি জোরে ঘুরান। আর হাত দিয়ে মাটির তাল ধরেন। এভাবে নানা আকারের মাটির পাত্র ও নানা জিনিস তৈরি করেন কুমাররা।
মেলা থেকে সেদিন আমরা অনেক টেপা পুতুল, ঘোড়া, হাতি, ছোট কলস কিনলাম। মামা বললেন, এত সুন্দর নকশা দেখছ, রং দেখছ -এ সবই গ্রামের শিল্পীদের তৈরি। নকশাগুলো তাঁরা মন থেকে আঁকেন। আর রং তৈরি করে শিম, সেগুন পাতার রস, কাঁঠাল গাছের বাকল থেকে। তবে আজকাল বাজার থেকে কেনা রং ও লাগানো হয়। মেলা থেকে কদমা, বাতাসা, মুড়কি ও খৈ কিনে শখের হাঁড়ি ভর্তি করে আমরা ফিরলাম। খুব মজা হলো।
মামা বললেন, তোমাদের কাল কুমারপাড়ায় নিয়ে যাব। পরদিন আমরা দেখতে গেলাম কুমারপাড়া। আনন্দপুর গ্রামের উত্তর দিকে আট-দশ বসতবাড়ি। এই নিয়ে কুমারপাড়া। এখানে সবাই ব্যস্ত। কেউ মাটির তাল চাক করে সাজিয়ে রাখছেন। কেউ-বা কাঠের চাকায় মাটি লাগিয়ে নানা আকারের পাত্র বানাচ্ছেন। কেউ-বা এগুলো সারি সারি করে শুকোতে দিচ্ছেন রোদে। পাশেই রয়েছে মাটির জিনিস পোড়ানোর চুলা। উঁচু ছোট্ট টিবির মতো এই চুলা। মাটির পোড়া গন্ধ
পেজ----৩৭
পাচ্ছি। আর ধোঁয়া বেরোচ্ছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ও কাজ করছে। মামা বললেন, হাঁড়ি কলসি ছাড়াও আমাদের দেশে এক সময় সুন্দর পোড়ামাটির ফলকের কাজ হতো। এর অন্য নাম টেরাকোটা। বাংলার অনেক পুরনো শিল্প এই টেরাকোটা। নকশা কর মাটির ফলক ইটের মতো পুড়িয়ে তৈরি করা হতো এই টেরাকোটা। শালবন বিহার, মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার ও দিনাজপুরের কান্তজির মন্দিরে এই টেরাকোটার কাজ রয়েছে। মাটির ফলকে ছবি এঁকে শুকিয়ে পোড়ানোর পর এগুলো এমন সুন্দর হয়ে ওঠে! ছোট ছোট ফলককে পাশাপাশি জোড়া দিয়ে বড় করা যায়। পোড়ামাটির এই ফলক বাংলায় প্রাচীন মৃৎশিল্প। মামা বললেন, টেরাকোটা বা পোড়ামাটির এসব কাজ এ দেশে শুরু হয়েছে হাজার বছর আগে।
আজকাল কি পোড়ামাটির এই শিল্প চর্চা হয় না? মামার কাছে জানতে চাইলাম আমরা। মামা বললেন, আজকাল ওরকম টেরাকোটা হচ্ছে না বটে, তবে পোড়ামাটির নকশার কদর বেড়েছে। সরকারি -বেসরকারি ভবনে আজকাল সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য নানা রকম নকশা করা মাটির ফলক ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদের দেশের কুমাররা এসব তৈরি করছেন। বললাম, আমরা এসব পোড়ামাটির কাজ দেখতে চাই।
মামা বললেন, সুযোগমতো এক সময় তোমাদের শালবন বিহারে নিয়ে যাব ।
----সংগৃহীত
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন