অবাক জলপান- সুকুমার রায় | পঞ্চম শ্রেণি বাংলা | Class 5 Bangal

 পেজ------৬৪



                       অবাক জলপান 

                         সুকুমার রায়



পাত্রগণ: পথিক। ঝুড়িওয়ালা। বৃদ্ধ। ছোকরা। খোকা। মামা।




                             প্রথম দৃশ্য 

                              রাজপথ 

(ছাতা মাথায় এক পথিকের প্রবেশ। পিঠে লাঠির আগায় লোটা-- বাঁধা পুঁটলি। উষ্ককখুষ্ক চুল। ভ্রান্ত চেহারা) 


পথিক : নাঃ একটু জল না পেলে আর চলছে না। সেই সকাল থেকে হেঁটে আসছি, এখনও  প্রায় এক ঘন্টার পথ বাকি। তেষ্টায় মগজের ঘিলু পর্যন্ত শুকিয়ে উঠল। কিন্তু জল চাই  কার কাছে?

অবাক জলপান। সুকুমার রায়। পঞ্চম শ্রেণি বাংলা



পেজ-----৬৫



গেরস্তর বাড়ি, দুপুর রোদে দরজা এঁটে সব ঘুম দিচ্ছে, ডাকলে সাড়া দেয় না। বেশি চ্যাঁচাতে  গেলে হয়তো লাঠি নিয়ে তেড়ে আসবে। পথেও লোকজন দেখছি নি। --ওই একজন আসছে! ওকেই জিজ্ঞেস করা যাক। 


            [ঝুড়ি মাথায় এক ব্যক্তির প্রবেশ]


পথিক : মশাই, একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন? ঝুড়িওয়ালা: জলপাই? জলপাই এখন কোথায় পাবেন? এ তো জলপাইয়ের সময় নয়। কাঁচা আম চান তো দিতে পারি --

পথিক : না, না আমি তা বলি নি --

ঝুড়িওয়ালা : না, কাঁচা আম আপনি বলেন নি, কিন্তু জলপাই চাচ্ছিলেন কিনা, তা তো আর এখন পাওয়া যাবে না, তাই বলছিলুম --

পথিক : না হে, আমি জলপাই চাচ্ছিনে--

ঝুড়িওয়ালা :চাচ্ছেন না তো, 'কোথায় পাব' 'কোথায় পাব' কচ্ছেন কেন? খামাখা এরকম করবার মানে কী?


পথিক : আপনি ভুল বুঝছেন-- আমি জল চাচ্ছিলাম--

ঝুড়িওয়ালা : জল চাচ্ছেন তো 'জল' বললেই হয়--'জলপাই' বলবার দরকার কী? জল আর জলপাই কি এক হলো? আলু আর আলুবোখরা কি সমান? মাছ ও যা আর মাছরাঙ্গাও তাই? বরকে কি আপনি বরকন্দাজ বলেন? চাল কিনতে গিয়ে কি চালতার খোঁজ করেন?

 পথিক : ঘাট হয়েছে মশাই। আপনার সঙ্গে কথা বলাই আমার অন্যায় হয়েছে। 

 ঝুড়িওয়ালা :অন্যায় তো হয়েছেই। দেখছেন ঝুড়ি নিয়ে যাচ্ছি -- তবে জল চাচ্ছেন কেন? ঝুড়িতে করে কি জল নেয়? লোকের সঙ্গে কথা কইতে গেলে একটু বিবেচনা করে বলতে হয়। 

                            [ ঝুড়িওয়ালার প্রস্থান] 

[পাশের বাড়ির জানালা খুলিয়া এক বৃদ্ধের হাসিমুখ বাহিরকরণ]


 বৃদ্ধ : কী হে? এত তর্কাতর্কি কিসের? 

 পথিক : আজ্ঞে না, তর্ক নয়। আমি জল চাচ্ছিলুম,  তা উনি সে কথা কানেই নেন না --- কেবলই  সাত- পাঁচ গপ্পো করতে লেগেছেন। তাই বলতে গেলুম তো রেগেমেগে অস্থির।

 

বৃদ্ধ : আরে দূর দূর। তুমিও যেমন! জিজ্ঞেস করবার আর লোক পাও নি? ও  হতভাগা জানেই বা কী আর বলবেই বা কী? ওর যে দাদা আছে, খালিসপুরে চাকরি করে।



পেজ----৬৬


সেটা তো একটা আস্ত গাধা। ও মুখ্যটা কী বলবে তোমায়? 

পথিক : কী জানি মশাই -- জলের কথা বলতেই কুয়োর জল, নদীর জল, পুকুরের জল, কলের জল, মামারবাড়ির জল বলে পাঁচ রকম ফর্দ শুনিয়ে দিলে--


বৃদ্ধ :  হুঁঃ ভাবলে খুব বাহাদুরি করেছি। তোমায় বোকামতো দেখে  খুব চাল চেলে নিয়েছে। ভারি তো ফর্দ করেছেন, আমি লিখে দিতে পারি, ও যদি পাঁচটা জল বলে থাকে তো আমি এক্ষুণি পঁচিশটা বলে দেব--

 পথিক : না মশাই, গুনিনি - আমার খেয়েদেয়ে কাজ নেই--

 বৃদ্ধ : তোমার কাজ না থাকলেও আমার কাজ থাকতে পারে তো? যাও, যাও, মেলা বকিয়ো না-একেবারে অপদার্থের  একশেষ। 

 

         [বৃদ্ধের সশব্দে জানালা বন্ধকরুণ ]

         [নেপথ্য বাড়ির ভিতরে বালকের পাঠ ]

         

   [পৃথিবীর তিন ভাগ জল এক ভাগ স্থল।সমুদ্রের জল লবণাক্ত, অতি বিস্বাদ। ]

   

পথিক : ওহে খোকা!  এদিকে শুনে যাও তো? 

[রুক্ষমূর্তি, মাথায় টাক, লম্বা দাড়ি খোকার মামা বাড়ি হইতে বাহির হইলেন ]


মামা : কে হে? পড়ার সময় ডাকাডাকি করতে এয়েছ? --(প্রথিককে দেখিয়া) ও! আমি মনে করেছিলুম পাড়ার কোনও ছোকরা বুঝি! আপনার কী দরকার? 


 পথিক : আজ্ঞে, জলতেষ্টায় বড় কষ্ট পাচ্ছি- তা একটু জলের খবর কেউ বলতে পারলে না। 

 [মামার তাড়াতাড়ি ঘরের দরজা খুলিয়া দেওয়া]

 


মামা : কেউ বলতে পারলে না? আসুন, আসুন, কী খবর চান, কী জানতে চান, বলুন দেখি? সব আমায় জিজ্ঞেস করুন, আমি বলে দিচ্ছি।

            [পথিককে মামার ঘরে টানিয়া নেওয়া]



পেজ-------৬৭


                             দ্বিতীয় দৃশ্য 

                             ঘরের ভিতর


[ ঘর নানা রকম যন্ত্র, নকশা, রাশি-রাশি বই ইত্যাদিতে সজ্জিত]


 মামা : কী বলছিলেন? জলের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন না? 

পথিক :  আজ্ঞে  হ্যাঁ, সেই সকাল থেকেই হাঁটতে হাঁটতে আসছি!

মামা : আ হা হা! কী উৎসাহ, কী আগ্রহ! শুনে ও সুখ হয়। এরকম জানবার আকাঙ্খা ক- জনের আছে, বলুন তো?  বসুন! বসুন!(কতকগুলি  ছবি, বই আর এক টুকরো খড়ি বাহির করিয়া) জলের কথা জানতে গেলে প্রথমে জানা দরকার, জল কাকে বলে, জলের কী গুণ--


পথিক : আজ্ঞে,  একটু খাবার জল যদি --

মামা : আসছে- ব্যস্ত হবেন না।  একে একে সব কথা আসবে। জল হচ্ছে দুইভাগ হাইড্রোজেন আর একভাগ অক্সিজেন। 

পথিক :  এই মাটি করেছে! 

মামা : বুঝলেন? রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জলকে বিশ্লেষণ করলে হয়-- হাইড্রোজেন  আর অক্সিজেন। আর হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের রাসায়নিক সংযোগ হলেই, তবে জল! শুনছেন তো?

পথিক : দেখুন  মশাই! কী করে যে কথাটা আপনাদের মাথায় ঢোকাব তা ভেবে পাইনে। বলি, বারবার করে যে বলছি- তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল, সেটা তো কেউ কানে নিচ্ছে না দেখি। একটা লোক তেষ্টায় জল জল করছে, তবু জল খেতে পায় না, এরকম কোথাও শুনেছেন? 


মামা : শুনেছি বইকি, চোখে দেখেছি। বদ্যিনাথকে কুকুড়ে কামড়াল, বদ্যিনাথের হলো হাইড্রোফোবিয়া-যাকে বলে জলাতঙ্ক। আর জল খেতে পারে না-যেই জল খেতে যায় অমনি গলায় খিচ ধরে। মহা মুশকিল।


পথিক : নাঃ এদের সঙ্গে পেরে ওঠা গেল না- কেনই মরতে এসেছিলাম এখানে? বলি মশাই, আপনার এখানে নোংরা জল আর দুর্গন্ধ জল ছাড়া ভালো জল খাঁটি জল কিছু নেই?  

মামা : আছে বইকি! এই দেখুন না বোতল - ভরা টাটকা খাঁটি ডিস্টিল ওয়াটার - যাকে বলে পরিশ্রুত জল।



পেজ--------৬৮

অবাক জলপান। সুকুমার রায়। পঞ্চম শ্রেণি বাংলা


[বড় সবুজ একটি বোতল আনিয়া মামা পথিককে দেখাইলেন]


পথিক : (ব্যস্ত হইয়া) এ জল কি খায়? 

মামা : না, ও জল খায় না, ওতে তো স্বাদ নেই- একেবারে বোবা জল কিনা, এইমাত্র তৈরি করে আনল- এখনও গরম রয়েছে।


                        [ পথিকের হতাশ ভাব]


তারপর যা বলছিলুম শুনুন- এই যে দেখছেন গন্ধওয়ালা নোংরা জল- এর মধ্যে দেখুন এই গোলাপি জল ঢেলে দিলুম- ব্যস, গোলাপি রং উড়ে সাদা হয়ে গেল। দেখলেন তো?

পথিক : না মশাই, কিছু দেখি নি, কিচ্ছু বুঝতে পারি নি, কিচ্ছু মানি না ও কিছু বিশ্বাস করি না। 

মামা : কী বললেন। আমার কথা বিশ্বাস করেন না? পথিক : না, করি না। আমি যা চাই, তা যতক্ষণ দেখাতে না পারেন, ততক্ষণ কিছু বিশ্বাস করব না।


পেজ-----৬৯



মামা : বটে, কোনটা দেখতে চান একবার বলুন দেখি- আমি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছি। 


পথিক : তা হলে দেখানে দেখি। সাদা, খাঁটি চমৎকার এক গেলাস খাবার জল নিয়ে দেখান দেখি। যাতে গন্ধ নেই, পোকা নেই, কলেরার পোকা নেই, ময়লা- টয়লা কিচ্ছু নেই, তা নিয়ে পরীক্ষা করে দেখান দেখি। খুব বড় একগেলাস ভর্তি জল নিয়ে দেখান তো!  


মামা : এক্ষুনি দেখিয়ে দিচ্ছি- ওরে ট্যাপা, দৌড়ে আমার কুঁজো থেকে এক গেলাস জল নিয়ে আয় তো। 


        [পাশের ঘরে দুপদাপ শব্দে খোকার দৌড়]

        

নিয়ে আসুক, তারপর দেখিয়ে দিচ্ছি। ওই জলে কী রকম হয়, আর নোংরা জলে কী রকম তফাত হয়, আমি সব দেখিয়ে দিচ্ছি।

          [ জল লইয়া  ট্যাপার প্রবেশ ]

          

এই খানে রাখ।


[ জল রাখিবামাত্র পথিকের আক্রমণ-মামার হাত হইতে জল কুড়িয়া এক নিঃশ্বাসে চুমুক দিয়া শেষ করা]


পথিক : আঃ বাঁচা গেল! 

মামা : (চটিয়া) এটা কী রকম হলো মশাই? 

পথিক : পরীক্ষা হলো- এক্সপেরিমেন্ট। এবার আপনি নোংরা জলটা একবার খেয়ে দেখান তো? কীরকম হয়? 


মামা :( ভীষণ রাগিয়া) কী বললেন? 


পথিক : আচ্ছা থাক, এখন নাই বা খেলেন - পরে খাবেন। আর গাঁয়ের মধ্যে আপনার মতো আনকোরা পাগল আর যতগুলো আছে, সবকটাকে খানিকটা করে খাইয়ে দেবেন। তারপর খাটিয়া তুলবার দরকার হলে আমায় খবর দেবেন -- আমি খুশি হয়ে ছুটে আসব,হতভাগা জোচ্চোর কোথাকার। 


                                  [পথিকের দ্রুত প্রস্থান]

                                  

       [পাশের গলিতে সুর করিয়া সে হাঁকিতে লাগিল - 'অবাক জলপান']-


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

এই দেশ এই মানুষ | পঞ্চম শ্রেণি বাংলা | Class 5 Bangla

নতুন দেশ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | সপ্তম শ্রেণি | Class 7 Bangla

বাংলা রচনা আমাদের জাতীয় পতাকা | সপ্তম শ্রেণির বাংলা ২য় পত্র | Class 7 Bangla second Paper